প্রশ্ন:-সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখো।
অথবা প্রশ্ন:- সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে যা জানো লেখো। প্রশ্ন :- সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে টীকা লেখ [Marks- ৮]
উত্তর:- ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে যে সকল উপজাতি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তাদের মধ্যে ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। সাঁওতালি ভাষায় এই আন্দোলন ‘খেরওয়ারি হুল’ নামে পরিচিত।
বাসস্থান : সরলপ্রাণ ও কর্মঠ সাঁওতালগণ মূলত বিহারের (ঝাড়খণ্ড) ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চল এবং বাঁকুড়া, পুরুলিয়া প্রভৃতির বনাঞ্চলে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি উক্ত অঞ্চলগুলিতে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা চালু করলে উচ্চহারে রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়ে তারা রাজমহল পার্বত্য অঞ্চল (দামিন-ই-কোহ) ও মুরশিদাবাদের একাংশে বনভূমি পরিস্কার করে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু এখানেও একাধিক কারণে তারা শোষিত হতে থাকলে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
বিদ্রোহের কারণ :
(১) উচ্চ রাজস্ব প্রদান : সাঁওতালদের আবাদি জমিতে উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা হয়েছিল, যা তাদের দেওয়ার সামর্থ ছিল না।
(২) উপশুল্ক : উচ্চহারে ভূমি রাজস্ব আদায় ছাড়াও স্থানীয় জমিদার, মহাজন প্রভৃতিগণ সাঁওতালদের কাছ থেকে বলপূর্বক একাধিক উপশুল্ক আদায় করতকার
(৩) মহাজনি শোষণ : জমিদারদের পাশাপাশি মহাজনগণ বিশেষত বহিরাগত মহাজনগণ (দিকু শ্রেণি) নানাভাৰে সাঁওতালদের শোষণ করত। যথা— (i) রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ সাঁওতালগণ মহাজনদের কাছ থেকে যে ঋণ নিত তার সুদের হার ছিল ৫০-৫০০ শতাংশ পর্যন্ত, (ii) মহাজনগণ ঋণ-সংক্রান্ত বন্ডে প্রদত্ত অর্থের বেশি অর্থ লিখিয়ে নিত, (iii) কেউ ঋণ পরিশোধ করতে চাইলে তাকে নানাভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে রাখা হত, (iv) ঋণগ্রহীতাগণ যতদিন না ঋণ পরিশোধ করতে পারতেন ততদিন মহাজনদের জমিতে, বেগারখাটা (কামিয়াতি) এবং বিনা পারিশ্রমিকে লাঙল দিতে হত (হারওয়াহি ) ইত্যাদি। –
(৪) ব্যবসায়ীদের কারচুপি : ব্যবসায়ীগণ সাঁওতালদের কাছ থেকে দ্রব্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে বেশি ওজনের বাটখারা (কেনারাম) এবং দ্রব্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কম ওজনের বাটখারা (বেচারাম) ব্যবহার করত
৫) রেলকর্মীদের অত্যাচার : লর্ড ডালহৌসির রাজত্বকালে রাজমহল থেকে ছোটোনাগপুর পার্বত্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে রেললাইন সম্প্রসারণের সময় রেলকর্মী ও সাঁওতালগণ নানাভাবে শোষিত ও নির্যাযিত হয়েছিল। যথা- (i) সাঁওতালদের কৃষিজমি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল, (ii) রেলের কাজে নিযুক্ত সাঁওতাল কর্মীদের উদয়াস্ত পরিশ্রম করালেও নামমাত্র মজুরি প্রদান করত, (iii) রেলকর্মী ও ঠিকাদারগণ সাঁওতালদের হাঁস-মুরগি-ছাগল ইত্যাদি কেড়ে নিত, এমন কি সাঁওতাল রমণীদের উপর সম্মানহানিকর ব্যবহার করত।
(৬) ইউরোপীয় আইন :- সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় ইউরোপীয় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনবিধি প্রচলনের চেষ্টা সাঁওতালদের নিজস্ব আইন ও বিচারপদ্ধতিতে আঘাত হেনেছিল।
(৭) ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টা :- একাধিক ইউরোপীয় মিশনারিগণ কর্তৃক সাঁওতালদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের প্রচেষ্টা সাঁওতালদের ক্ষুব্ধ করেছিল।
(৮) লিজ ব্যবস্থা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর লিজ ব্যবস্থার মাধ্যমে জমিদারগণ সাঁওতালদের জমিগুলি হস্তগত করেছিল এবং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত অর্থপ্রদানে স্বীকৃত হয়েছিল। যার ফলে সাঁওতালদের উপর রাজস্বের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
(৯) ধর্মীয় উদ্দীপনা : সর্বোপরি বিদ্রোহের নেতা সিধু ও কানু ঘোষণা করেছিল যে, “তাদের দেবতা ‘বেঙ্গা’ তাদেরকে (সাঁওতালগণকে ) ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এই বিদ্রোহে তারা নিশ্চিত জয়লাভ করবে।” এইরূপ ধর্মীয় উদ্দীপনায় সাঁওতালগণ প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ শুরু করেছিল।
** সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা :- ১৮৫৫ খ্রি: ৩০ শে জুন সিধু ও কানু নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে ভগনাডিহির মাঠে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল ‘ স্বাধীন সাঁওতাল পরগণা ‘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মিলিত হয়ে এই সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা করেন ।
*বিদ্রোহের নেতৃত্ব ও ব্যাপ্তি : বিদ্রোহীরা সিধু, কানহু, ডোমন মাঝি, চাঁদ, ভৈরব, কালো প্রামাণিকের নেতৃত্বে মহাজনদের আড়ত, বণিকদের বাড়ি, নীলকুঠি ও জমিদারের কাছারি আক্রমণ করে। রেলস্টেশন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে। এভাবে রাজমহল থেকে মুরশিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মুরশিদাবাদ, বীরভূমে পাকুড় ও সাঁওতাল পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজবাহিনী পর্যদস্তু হয়ে পড়ে। সবশেষে, ১৮৫৬ খ্রি: বিদ্রোহীরা তির, ধনুক, বল্লম সম্বল করে কলকাতা দখলের উদ্দেশ্যে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লে শেষপর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানি প্রচণ্ড দমনপীড়নের মাধ্যমে এই বিদ্রোহ দমন করে ।
*বিদ্রোহ ও তা দমন :- ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন সিধু ও কানুর নেতৃত্বে প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে এবং ৭ জুলাই প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ ঘোষলা করে। প্রাথমিক পর্বে সাঁওতালদের হাতে স্থানীয় জমিদার কেনারাম ভগত ও দিঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত খুন হন। সাঁওতালগণ সর্বত্র রেলস্টেশন, থানা, ডাকঘর ইত্যাদি ধ্বংস করে। জমিদার ও মহাজনদের বাড়িতে লুঠ চালায়। বিহারের ঝাড়খণ্ডের পার্বত্য অঞ্চল থেকে বীরভূমের সাঁইথিয়া, রামপুরহাট প্রভৃতি স্থান হয়ে সাঁওতালগণ কলকাতা দখলের চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত লর্ড ডালহৌসির নির্দেশে ও মেজর জেনারেল লয়েডের নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী বারহাইতের যুদ্ধে সাঁওতালদের পরাজিত করে। ৫ নং পদাতিক বাহিনী ৩৬টি গ্রাম ধ্বংস সহ প্রায় ২৫০০০ সাঁওতালকে হত্যা করে। সিধু ও কানু সহ অনেকের ফাঁসি হয়।
*ফলাফল ও গুরুত্ব : ব্রিটিশের ন্যায় প্রবল শক্তিসম্পন্ন বাহিনীর কাছে সাঁওতালদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হলেও তা একেবারে নিষ্ফল ছিল না। যথা—
(১) বিদ্রোহের ব্যাপকতা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার সাঁওতালদের একটি পৃথক উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
(২) ভাগলপুর ও বীরভূমের কিছু অংশ এবং দেওঘর ও দুমকা সহ প্রায় ৫৫০০ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে পৃথক ‘ সাঁওতাল পরগণা ‘ গঠন করা হয়।
(৩) পরবর্তী কয়েক বছর নবগঠিত পরগনায় মহাজন ও মিশনারিদের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
(৪) মহাজনদের সুদের হারে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। যদিও ভূমি-রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে।
(৫) সাঁওতাল মাঝি বা প্রধানদের দ্বারা পরিচালিত নিজস্ব আইন বা বিচারব্যবস্থা পূর্ণ বহাল রাখা হয় ইত্যাদি।
**উপসংহার : সমসাময়িক কলকাতা কেন্দ্রিক বেশ কিছু পত্রিকা সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে বিরুদ্ধ মতামত জ্ঞাপন করলেও প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহ ছিল ইংরেজ ও তাদের দোসর জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবীদের সার্থক প্রতিবাদ। এই বিদ্রোহ পরবর্তী নীলবিদ্রোহ পাবনা ও বগুড়ায় কৃষকদের অভ্যুত্থানের অনুপ্রেরণা দান করেছিল। অধ্যাপক সুপ্রকাশ রায় বলেছেন— “সাঁওতাল বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরাজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিল এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরূপ।”
FAQ’S
১) সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা কবে হয় ?
উত্তর:- ১৮৫৫ খ্রি: ৩০ শে জুন।
২) সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা কারা ছিলেন ?
উত্তর:- সিধু, কানু, ডোমন মাঝি, চাঁদ ভৈরব, কালো প্রামানিক প্রমূখ
৩) সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্লোগান কি ছিল ?
উত্তর:- ‘ চল চল ভাগনা ডিহি ‘
৪) সাঁওতালি ভাষায় হুল কথার অর্থ কি ছিল ?
উত্তর:- বিদ্রোহ
৫) সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক কি ছিল ?
উত্তর:- শাল গাছ
৬) কামিয়াতি ও হারওয়াহি কি ?
উত্তর:- সাঁওতালদের ওপর এক ধরনের বন্ড প্রথা ।
৭) সাঁওতাল বিদ্রোহ কবে দমন করা হয় ?
উত্তর:- ১৮৫৬ ফেব্রুয়ারি মাসে।