PDF Notes Selector

Select a Class for PDF Notes

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড: রাওলাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলার সময় পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে জালিয়ান ওয়ালাবাগ উদ্যানে এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটে (১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড গুলির অন্যতম ছিল এই জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড।

** ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে পাঞ্জাবের ভৌগোলিক অবস্থান, পাঞ্জাবীদের স্বাধীনতা স্মৃতি, বীরত্ব প্রভৃতি এই অঞ্চল ও এখানকার জনগনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাঞ্জাবের জেলাগুলি থেকে বাধ্যতামূলক ভাবে সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। যুদ্ধে বহু সৈনিক হতাহত হয়। যুদ্ধ শেষে সৈনিকদের ছাঁটাই করা হলে প্রাক্তন সৈনিকরা বেকার হয়ে পড়ে। এছাড়া বিশ্বযুদ্ধের জন্য নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। এর প্রভাবও পড়েছিল। সব মিলে পাঞ্জাবের জনজীবন অশান্ত হয়ে ওঠে।

** রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গান্ধিজী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেন। সারা দেশে ৬ এপ্রিল ধর্মঘট পালিত হয়। পাঞ্জাবের জনপ্রিয় নেতা ডাঃ সত্যপাল ও ডাঃ সৈফুদ্দিন কিচলুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাঞ্জাবে প্রবল গণ আন্দোলন শুরু হয়। প্রতিবাদ হিসাবে জনতা মিছিল করে। পুলিশ তার উপর গুলি চালায়। বহু মানুষ হতাহত হয়। সরকারি হিসাবে ২৮ জন নিহত এবং ১২৩ জন আহত হয়েছিল। বেসরকারি মতে ঐ সংখ্যা আরও বেশী ছিল। এজন্য গান্ধীজি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের আহ্বানকে ‘ হিমালয় সদৃশ ভুল’  (Himalayan blunder) বলেন।

** অগ্নিগর্ভ পাঞ্জাবের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ইতিপূর্বেই মুখ্য প্রশাসক পদে মাইকেল ‘ও ডায়ার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি অমৃতসরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। যথেচ্ছভাবে গ্রেপ্তার শুরু হয়। সভা-সমিতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এই সময় অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগ-এ একটি সভা হয়। ডাঃ সত্যপাল ও ডাঃ সৈফুদ্দিন কিচলু’র মুক্তির দাবীতে ও রাওলাট আইনের প্রতিবাদে সভাটি অনুষ্ঠিত হয় (১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রিঃ)। স্থানটি ছিল চারদিকে বড় বড় পাকা বাড়ি ও পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটি উদ্যান। উদ্যানে প্রবেশের জন্য একটি প্রশস্ত পথ ও বেরিয়ে যাওয়ার জন্য চারটি সরু গলিপথ ছিল। সভায় উপস্থিত হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার নিরস্ত্র শিশু ও নারী পুরুষ। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞা না জানা বৈশাখী মেলায় আসা গ্রামের বহু সাধারণ মানুষও ছিলেন। তখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার এই সভা নিষিদ্ধ করে সভাস্থল ঘিরে ফেলেন। জালিয়ানওয়ালা বাগের যাওয়া আসার পথ গুলি বন্ধ করেন। তারপর কোনো সাবধান বানী ছাড়াই ১০০ গজ দূর থেকে ৫০ জন রাইফেল ধারী পুলিশ ১০ মিনিট ধরে ১৬০০ রাউন্ড গুলি বর্ষন করে। এর ফলে বহু নরনারী হতাহত হয়। সরকারী হিসাব অনুযায়ী ৩৭৯ জন নিহত এবং ১২০০ জন আহত হয়। বেসরকারী হিসাব অনুযায়ী নিহত ও আহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশী ছিল। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম ক্ষমা স্বীকার করা হয়নি। উপরন্তু পাঞ্জাবে সান্ধ্য আইন জারী করা হয়। মৃতদেহ গুলি তাদের আত্মীয়রা নিয়ে যেতে পারেনি। আহতদের চিকিৎসা বা সেবা শুশ্রুষা করতে দেওয়া হয়নি। অমৃতসর ছাড়াও পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ নির্মম ব্যবহার করে। বেতমারা, হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়া, চড়া রোদে হাত-পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা প্রভৃতি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। এছাড়াও সরকার মার্শাল ল কমিশন গঠন করে ৫১ জনকে মৃত্যু দণ্ড দেয়।

** প্রতিক্রিয়া: জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড সমগ্র দেশে তীব্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বিপানচন্দ্রের মতে বিদ্যুতের চকিত আলোর মত পাঞ্জাবের ঘটনাবলি দেশের জনসাধারণের কাছে সভ্যতা ও সাম্রাজ্যবাদের মুখোশধারী বিদেশি শাসনের কদর্য ও ভয়াবহ রূপটি উদ্‌ঘাটিত করে দেয়। ঐতিহাসিক টমসন এবং গ্যারাট বলেন যে “জালিয়ানওয়ালাবাগের’ ঘটনা সিপাহী বিদ্রোহের মত এক গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী ঘটনা।” ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলেন “… এই ঘটনা অতি অস্বাভাবিক, অতি পাশবিক স্বীয় বৈশিষ্টে এই ঘটনা একক”। সর্বস্তরের কংগ্রেস নেতারা ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগত ভাবে এই ঘটনার নিন্দা করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘৃণাভরে ইংরেজ সরকার এর দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। বড়োলাটের শাসন পরিষদের একমাত্র ভারতীয় সদস্য স্যার সি. এস. নায়ারও পদত্যাগ করেছিলেন। ভারতব্যাপী এত আন্দোলন সত্ত্বেও রাওলাট আইন কিন্তু বাতিল হয়নি। আন্দোলনে হিংসার প্রবেশ এই অজুহাত দেখিয়ে ১৯১৯ সালের জুলাই মাসে গান্ধিজিও আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। যদিও তিনি বলেন-  This Satanic government Can not be mended, it must be ended. আর সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে ‘Himalayan blunder’ বলেন।

** গুরুত্ব: জুডিথ ব্রাউনের মতে গান্ধিজির রাওলাট সত্যাগ্রহ ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ এর দ্বারা রাওলাট আইন প্রত্যাহৃত হয়নি বা এই আন্দোলন ভারতের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়নি, বা সর্বত্র শান্তিপূর্ণও হয়নি। এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন যে ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে জুডিথ ব্রাউনের ওই ধরনের বক্তব্যকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ডঃ রবীন্দ্র কুমার বলেন, রাওলাট সত্যাগ্রহের দ্বারা গান্ধিজি প্রমাণ করেন যে, সর্বভারতীয় নেতৃত্ব গ্রহণের যোগ্যতা ও কর্মপন্থা তাঁর আছে এবং তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা শ্রেণি, বর্ণ ও ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সুসংহত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। একই সঙ্গে এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায় থেকে গান্ধি অনুরাগী বেশ কিছু সর্বভারতীয় নেতা তৈরি হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ৬ই এপ্রিলের হরতাল গান্ধিজীকে সর্বভারতীয় নেতায় পরিণত করে। শহীদের রক্ত শীঘ্র তাঁকে ভারতের মুকুটহীন রাজায় পরিণত করে। সুমিত সরকার Modern India গ্ৰন্থে বলেছেন–‘the biggest and most violent anti- British upsurge which India had seen since 1857’.

**উপসংহার:- সমস্ত দিক বিচার বিশ্লেষণ করে মূল্যায়নে বলা হয় যে, তিনি হলেন ভারতের ইতিহাসের মহান সম্রাট। জহরলাল নেহরু তাঁকে ‘Father of Indian Nationalism’ বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক ভারতের আদর্শ তাঁর ভিত্তির উপর অবস্থান করে দাঁড়িয়ে আছে।

Leave a Comment