ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের বিরোধের কারণ

ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের বিরোধের কারণ : আলিবর্দির পর বাংলার নবাব হন সিরাজ-উদ্‌দৌলা। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও দেশপ্রেমিক। নবাব আলিবর্দির সময় থেকেই ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি  হতে থাকে। কারণ আলিবর্দি ইংরেজদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকে প্রশ্রয় দিতেন না। অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় প্রভুত্ব স্থাপন করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে নবাবের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ বাধে। এই বিরোধ নবাব সিরাজের সময় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়। এই বিরোধের কারণগুলি হল-

 প্রথমত, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সিংহাসনে সিরাজের আগমনকে সুনজরে দেখেনি। তাই প্রথানুযায়ী সিরাজের সিংহাসন আরোহণকালে কোম্পানি কোনো নজরানা প্রদান করে নবাবের নিকট আনুগত্য প্রকাশ করেনি। এর ফলে সিরাজ ও কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

**দস্তকের অপব্যবহার: ইংরেজরা ব্যাবসাবাণিজ্য করার জন্য নবাবের কাছ থেকে যে ছাড়পত্র বা দস্তক লাভ করেছিল, তারা তার অপব্যবহার করছিল। কোম্পানির কর্মচারী ব্যক্তিগতভাবে দস্তক ব্যবহার করে অধিক মুনাফা লাভ করতে থাকে। ফলে এদেশের বণিক সম্প্রদায় চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দেশীয় বণিকদের স্বার্থে নবাব তাদের উপর শুল্ক প্রত্যাহার করে নিলে ইংরেজ কর্মচারীরা নবাবের প্রতি ক্রুদ্ধ হন।

** কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দান: সিরাজের পরম শত্রু ঢাকার জমিদার রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে  ইংরেজ কোম্পানি কোলকাতায় আশ্রয় দান করেন। সিরাজ ইংরেজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন যে তাঁরা  যেন কৃষ্ণদাসকে নবাবের নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি নবাবের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে। ফলে সিরাজ ইংরেজদের প্রতি ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। 

** কলকাতা দুর্গ-সংস্কার: ফরাসি ও ইংরেজরা নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে কলকাতা দুর্গটি-রোগ সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়। এক্ষেত্রে সিরাজ উভয়কেই একাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ফরাসিরা নবাবের নির্দেশ মান্য করলেও ইংরেজ কোম্পানি এই নির্দেশ অমান্য করে দুর্গ নির্মাণ ও সংস্কার করতে থাকে। এর ফলে সিরাজ ইংরেজদের প্রতি ক্ষুণ্ণ হন।

**অন্ধকূপ হত্যা: সিরাজের বিরুদ্ধে তাঁর নিকট আত্মীয়া ঘসেটি বেগম যে ষড়যন্ত্র করছিল,  নবাব তা জানতে পারেন। ফলে সিরাজ ঘসেটি বেগম ও ষড়যন্ত্রকারী শওকত জঙ্গকে নজরবন্দি করে রাখেন। অপরদিকে ইংরেজ গভর্নর ড্রেক কোলকাতা দুর্গ নির্মাণ স্থগিত রাখতে পারবে না বলে জানিয়ে দেন। ফলে সিরাজ ইংরেজদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের কাশিমবাজার বাণিজ্যকুঠি অধিকার করে কোলকাতা অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি কোলকাতা দুর্গ জয় করে ১৪৬ জন ইংরেজকে একটি ১৪×১২ * ফুট ঘরে বন্দি করে রাখেন। পরের দিন ১২৩ জন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই ঘটনা ‘অন্ধকূপ হত্যা’ নামে পরিচিত। পরে লর্ড ক্লাইভের অধীনে ইংরেজরা পালটা আক্রমণ করে কলিকাতা দখল করেন। শেষ পর্যন্ত ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে আলিনগরের সন্ধি দ্বারা ইংরেজ ও সিরাজের মধ্যে যুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু এই সন্ধি ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে কোনো স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। 

*”সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: ক্লাইভ নবাব সিরাজ-উদদৌলার বিরুদ্ধে বাংলার রাজধানী মুরশিদাবাদে ষড়যন্ত্রের জাল পাতেন। এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন মিরজাফর, জগৎ শেঠ, মানিকচাঁদ, রোনা রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখ নবাবের উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ। মিরজাফরের সঙ্গে ক্লাইভের গোপন চুক্তিতে স্থির হয় য় যে, ক্লাইভ ১৭৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মিরজাফরকে বাংলার মসনদে বসিয়ে বাংলার নবাবের নিকট থেকে সর্বপ্রকার বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা লাভ করবেন।আধুনিককালের ঐতিহাসিকগণের মতে, ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবই পলাশির যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল। এরই পরিণতি হল ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশির যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হতভাগ্য সিরাজের পরাজয় ঘটে।

Leave a Comment