চুয়ার ও পিন্ডারী বিদ্রোহ

চুয়ার ও পিন্ডারী বিদ্রোহ :  ভারতে উপনিবেশিক শাসনের প্রথম পর্বের উপজাতীয় বিদ্রেহগুলিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করা হয়। কোম্পানী প্রশাসন বিদ্রোহগুলিকে আইন-শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা হিসাবে দেখেছেন। উপজাতিগুলিকে সভ্যতা বিরোধী বলে মনে আদিম প্রবৃত্তি করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগন উপ- জাতীয় বিদ্রোহগুলিকে আধুনিক জাতীয়তাবাদের প্রাক-ইতিহাস হিসাবে তুলে ধরেছেন। এরিক স্টোবাস– এর মতো ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, বিদ্রোহ গুলি ছিল প্রাথমিক প্রতিরোধ।

            চুয়াড় বিদ্রোহ

চুয়াড়রা ছিল মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে ‘জঙ্গল মহল’ নামক বনাঞ্চলের অধিবাসী, কৃষিকার্য ও পশু  শিকারের পাশাপাশি তারা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, ও ধলভূম- এর স্থানীয় জমিদারদের অধিনে সৈনিকের কাজ করে জীবিকা চালাতেন। এই সব স্থানে কোম্পানীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে জমিদারদের ওপর বিপুল যে রাজস্বের বোঝা চাপানো হয় তা দেবার মতো ছিলনা। এই অবস্থায়  জমিদাররা বিদ্রোহ ঘোষনা করলে তাঁদের পাইক- চুয়াররাও এই বিদ্রোহে যোগদান করে। 1768 খ্রীঃ  ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। এই বিদ্রোহ ব্যার্থ হলে তিনি পরের বছর আবার বিদ্রোহ ঘোষনা করলে প্রায় ১০ হাজার চুয়াড় এতে অংশ দেয়। এরপর 1771 খ্রীঃ ধাদকার শ্যামগঞ্জন-এর নেতৃত্বে চুয়াররা আবার বিদ্রোহী হয়।

** তবে সবচেয়ে উল্যেখযোগ্য ছিল ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে সংঘটিত চুয়াড় বিদ্রোহ । এই বিদ্রোহের একটি গুরুত্ব পূর্ণ বৈশিষ্ঠ্য উড়িষ্যার পাইকরা এতে যোগদান করে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চুয়াড়রা অবাধ লুন্ঠন চালায়  এবং জমিদার ও তার আমলাদের হত্যা করেন। অনিরুদ্ধ রায় দেখিয়েছে , উত্তেজনা প্রশমনে মেদিনীপুরের কালেক্টর চুয়ার ও পাইক সর্দারদের বেতনের বিনিময়ে  পুলিশ বাহিনীতে নিযুক্তি এবং তাদের দ্বারা ঐ অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

**শশীভূষন চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, চুয়ার বিদ্রোহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে জমিদার ও অনুচর বর্গের সংগ্রাম হলেও প্রজারাও যে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, তা তাদের সংগ্রামী আচরন থেকে বোঝা যায়।নরহরি কবিরাজও দেখিয়েছেন, চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল নীম্ন শ্রেনীর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। যার মূল শক্তি ছিল কৃষক। তাছাড়া অনিরুদ্ধ রায় দেখিয়েছেন, চুয়াড় ও পাইকদের যতই ডাকাত ওলুন্ঠনকারি বলা হোক না কেন, তারা শৃঙ্খলা বন্ধ ছিল। সাধারণ কৃষক ও স্থানীয় জমিদাররাও চুয়ারদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়েছিলেন।

          পিন্ডারি বিদ্রোহ

পিন্ডারি কথাটিক আক্ষরিক অর্থে  পিন্ডা নামে এক মাদক দ্রব্য পানকারিকে বোঝায়। প্রচলিত অর্থে পিন্ডারি বোলতে একটি যুদ্ধবাজ লুন্ঠনকারি সম্প্রদায়কে বোঝায়। ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা পিন্ডারিদের জন্ম সুত্রে দস্যু ও লুটেরা বলে বর্ণনা করেছেন। কর্মচ্যুত সৈন্য ও জমিচ্যুত গ্রাম বাসীদের নিয়ে পিন্ডারি বাহিনী গড়ে উঠেছিল বলে  অধিকাংশ ঐতিহাসিকই মনে করেন। পিন্ডারিরা অধিকাংশই দেশিয় রাজার অধিনে অশ্বারোহী হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে তারা কর্মহীন হয়ে পড়ে। তাই মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পিন্ডারিরা ব্যাপক লুন্ঠন চালায়। গ্রামে গ্ৰামে বিস্তীর্ণ গ দুর্ধর্ষ অভিমান চালিয়ে গ্রাম বাসীদের কাছ থেকে তারা বলপূর্বক কর আদায় করতো। অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন, মারাঠা নেতা সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে পিন্ডারিদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। জন ম্যালকম লিখেছেন, The pindaris had neither the tie of religion nor of national feeling. They were men from all lands and all religions

**তবে এ কথা ঠিক, পিন্ডারিরা ইংরেজ শাসক – দের যথেষ্ঠ অসুবিধায় ফেলেছিল। গ্রামবাসীদের ওপর পিন্ডারি বাহিনী পরিচালিত ব্যাপক ও বিধ্বংসী লুণ্ঠনের ফলে ইংরেজ কোম্পানী সংশ্লিষ্ঠ এলাকা থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমান উল্যেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছিল। তাছাড়া পিন্ডারিদের হিংস্র অভিযান গাঙ্গেয় উপত্যকার ঘনবসতি অঞ্চলে – ব্রিটিশ বানিজ্যের -অগ্রগতি রুদ্ধ করেছিল। তাই ইংরেজরা পিন্ডারিদের দমন করতে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে ওঠে। গর্ভনর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস পিন্ডারিদের দমন করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন। লর্ড হেস্টিংস ১লক্ষ্য ১৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পিন্ডারিদের চর্তুদিক থেকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করেন এবং পরিশেষে হেস্টিংস -এর প্রচেষ্ঠায় পিন্ডারিরা সম্পূর্ন ভাবে দমিত হয়। ম্যালকম -এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অধিকাংশ পিন্ডারিরা ভারতীয় জনগনের সঙ্গের মিলে যায় এবং তাদের অনেকেই দক্ষ চাষী হিসাবে কৃষিকাজে নিযুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।

Leave a Comment