১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেনফোর্ড-সংষ্কার আইন

 ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেনফোর্ড-সংষ্কার আইন : ব্রিটিশ উপনিবেশিক নীতি অনুযায়ী উপনিবেশগুলিকে ধাপে ধাপে শাসন সংস্কার করা হত। উপনিবেশের জনগনের আশা আকাঙ্খার দিকে দৃষ্টি রেখে তাদের স্বায়ত্ত শাসনের উপযুক্ত করে তোলা হত। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতবাসীর আশাপূরণ করেনি। মুসলিমদের পৃথক নির্বাচন স্বীকৃতি দিয়েও কংগ্রেস, মুসলিম লীগের সঙ্গে যৌথ শাসন সংস্কারের দাবীতে লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬ খ্রিঃ) করে। এছাড়া যুদ্ধজনিত বিশেষ অর্থনৈতিক চাপের মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকার খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতবাসীর কাছে কিছুটা দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই ভারতবাসীকে খুশী করা জন্য কিছু ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। ১৯১৭ সালে তৎকালীন ভারত সচিব লর্ড মন্টেগু কমন্সসভায় এক ঘোষণায় বলেন যে, যুদ্ধান্তে ভারতকে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দেওয়া হবে। ওই বছরেই অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি ভারতে আসেন। তখন ভারতের বড়োলাট বা ভাইসরয় ছিলেন লর্ড চেমসফোর্ড। মন্টেগু ও চেমসফোর্ডের যৌথ রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন পাশ করে।

** ক্ষমতা ও দায়িত্ব বন্টন: এই শাসন সংস্কারের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে বন্টন করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, রেলপথ, মুদ্রা, পররাষ্ট্র নীতি, শুল্ক, ডাক ব্যবস্থা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয়। অপরপক্ষে, প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে আইন-শৃংখলা রক্ষা, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, রাজস্ব, যোগাযোগ প্রভৃতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

**কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ: নতুন সংস্কার আইন অনুযায়ী ৭ জন সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ গঠিত হয়। বলা হয়, ৭ জন সদস্যের মধ্যে অন্তত ৩ জন সদস্যকে ভারতীয় হতে হবে। শাসন পরিষদের সাহায্যে বড়োলাট নিজ দায়িত্বে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। তিনি ভারতসচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন, ভারতীয় আইনসভার কাছে নয়।

**কেন্দ্রীয় আইনসভা: কেন্দ্রে দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষে ৬০ জন সদস্যের মধ্যে ২৭ জন বড়োলাট কর্তৃক মনোনীত এবং বাকি ৩৩ জন সদস্যকে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা হয়। নিম্নকক্ষের ১৪০ জন (পরে ১৪৫ জন) সদস্যের মধ্যে ৪০ জন মনোনীত এবং ১০০ জনকে (পরে ১০৫ জন) নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা হয়। উভয় কক্ষেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টিত হলেও কেবল কেন্দ্রীয় আইনসভাই সারা ভারতের জন্য আইন প্রনয়ণ করতে পারত। কোনো কোনো বিষয়ে আইন সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপনের পূর্বে বড়োলাটের অনুমতি নেওয়া অপরিহার্য ছিল। এছাড়া প্রয়োজন মত বড়োলাট অর্ডিন্যান্স বলেও আইন প্রণয়ন করতে পারতেন।

**প্রদেশে দ্বৈত শাসন: প্রদেশ গুলিতে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা স্থাপিত হয়। আইনসভার সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৭০ জন নির্বাচিত এবং ৩০ জন গভর্নর কর্তৃক মনোনীত করার ব্যবস্থা হয়। প্রাদেশিক সরকারগুলির দায়িত্ব সংরক্ষিত এবং হস্তান্তরিত বিষয়- এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়। আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, প্রশাসন, অর্থ, বিচার, শ্রম প্রভৃতি বিষয়গুলি সংরক্ষিত বিষয় হয়। এই বিষয়গুলির পরিচালনার দায়িত্ব ছিল প্রাদেশিক গভর্নর ও তাঁর কার্যনির্বাহক সভার উপর। অপরপক্ষে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি ছিল হস্তান্তরিত বিষয়। এগুলি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল প্রাদেশিক মন্ত্রিদের উপর। এই মন্ত্রিরা তাঁদের কাজ কর্মের জন্য প্রাদেশিক আইনসভায় কোনো আইন প্রবর্তন করলে গভর্নর জেনারেল তা নাকচ করে দিতে পারতেন। এই ভাবে এই সংস্কার আইন প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে দ্বৈত (Dyarchy) শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে।

**সমালোচনা: সরকারি তরফ থেকে স্বায়ত্বশাসন প্রদানের ঘোষণা এবং ১৯১৭ সালে সংস্কার কমিশন বসিয়ে জনমত সংগ্রহ ইত্যাদি করা হল, কিন্তু মন্ট -ফোর্ড আইন পাশ হলে দেখা গেল ভারতীয়দের অত্যন্ত সীমিত পরিমাণ স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রে ভাইসরয় এবং প্রদেশে গভর্নর সর্বশক্তির অধিকারী হন। তাঁরা ইচ্ছা করলেই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নাকচ করতে পারতেন। মুসলিমদের পৃথক নির্বাচনের ফলে সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পায়। বাংলার আইনসভার ক্ষমতা আরও সীমিত ছিল। প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থা চালু হলে তৎকালীন সময়ে যে বিদেশি পুঁজিপতিরা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এখনকার নবগঠিত প্রাদেশিক কাউন্সিলে তাদের ১০ জন প্রতিনিধিকে সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য- যাতে নতুন রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তাদের আর্থিক স্বার্থ কোনোভাবেই ক্ষুন্ন না হয়। 

Leave a Comment